কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

শিক্ষকরাই বোঝেন না শিক্ষার্থীর কী হবে

‘সৃজনশীল প্রশ্নপত্র’ নিয়ে দেশের মাধ্যমিক স্তরে এখনও হযবরল অবস্থা। ভালোভাবে শিক্ষক প্রশিক্ষণ না দিয়েই একের পর এক বিষয়ে চালু করা এ প্রশ্ন পদ্ধতির কারণে একাধিক পাবলিক পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা হোঁচট খেয়েছে। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষাতেও গণিত বিষয়ের সৃজনশীলে পরীক্ষার্থীরা ‘ধরা’ খাওয়ার কারণে সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫ কমে গেছে ব্যাপক হারে।

আইসিটি ও বিজ্ঞানের নানা বিষয়েও অনেক শিক্ষা বোর্ডে শিক্ষার্থীরা ধরাশায়ী হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের। সৃজনশীল প্রশ্নপত্র বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের সংকট সেখানে সবচেয়ে তীব্র। এসব অঞ্চলে বসবাসকারী অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বিষয়ে দক্ষ করে তোলার জন্য সরকারিভাবেও আলাদা কোনো উদ্যোগ নেই। জানা গেছে, প্রায় একযুগ আগে সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হলেও এখন পর্যন্ত তা আয়ত্ত করতে পেরেছেন সারাদেশের মাত্র ৫৮ শতাংশ শিক্ষক। খোদ সরকারি সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। জানুয়ারিতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওই সমীক্ষা চালায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। সম্প্রতি এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়।

তবে বাস্তবে এ চিত্র আরও করুণ বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। যশোর অঞ্চলের এক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, সৃজনশীল বোঝে এবং প্রশ্ন করতে পারেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো। তিনি বলেন, আসলে শিক্ষকরাই ভালো করে বিষয়টি বোঝেন না। ছাত্ররা বুঝবে কীভাবে? খুলনা অঞ্চলের এক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকরা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিজেরা প্রণয়ন করেন না। তারা সৃজনশীলে ভয় পান। কোথাও শিক্ষক সমিতি আবার কোথাও বিভিন্ন পেশাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রশ্ন কিনে আনে স্কুলগুলো। আবার অনেকে গাইড বই দেখে প্রশ্ন তৈরি করেন। অথচ গাইড ও নোটবইয়ের দাপট কমাতেই এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।

বিষয়টি স্বীকার করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করতে যে পরিমাণ দক্ষতা দরকার তা অনেক শিক্ষকেরই নেই। হয়তো টেনেটুনে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন শিক্ষকরা করেন। কিন্তু ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন অনেকেই গাইড বই দেখে তৈরি করেন। অনেকে আবার নানাভাবে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সৃজনশীলে আওতাভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে গণিতে। গত ৬ মে চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এতে সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে গণিতে। শিক্ষক ও বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা বলছেন, দেশের মফস্বল এলাকায় গণিতের সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির দক্ষ শিক্ষক এক রকম পাওয়া যায় না বললেই চলে। ভালো শিক্ষকরা সবাই রাজধানী ঢাকায় বসবাস করেন। ফলে গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা সত্যিকারের দক্ষ শিক্ষকের শিক্ষাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক সমকালকে বলেন, এবারের এসএসসিতে তাদের বোর্ডে গণিতে সর্বাধিক ১৪ দশমিক ৭৯ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এর মধ্যে মানবিকের শিক্ষার্থীই বেশি। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরের শিক্ষার্থীরা খারাপ করেনি। ঢাকা বোর্ডের অধীন অন্যান্য জেলার প্রান্তিক জনপদে গণিতের ফল খারাপ হয়েছে।

বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, তার বোর্ডে সর্বাধিক ১৮ দশমিক ৩৬ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে গণিতে।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কবির আহমদ বলেন, তাদের বোর্ডে গণিতে সর্বাধিক ২৪ দশমিক ৭২ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহেদা ইসলাম বলেন, এ বোর্ডেও গণিতে সর্বাধিক ১৩ দশমিক ৫৭ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। গণিতে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ি জেলাগুলোতে সংকট আছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষক বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তোফাজ্জুর রহমান বলেন, এ বোর্ডে সবচেয়ে বেশি ১২ দশমিক ৬১ ভাগ অকৃতকার্য হয়েছে গণিতে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গণিতে গ্রাম পর্যায়ে সৃজনশীলে প্রশিক্ষিত দক্ষ শিক্ষক এখনও নেই। এটিকে গণিতে খারাপ ফল হওয়ার স্থায়ী কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। শিক্ষা বোর্ডের কর্ণধার সবাই এ পরিস্থিতির উত্তরণ চান।

এ বিষয়ে কথা হয় তৃণমূল পর্যায়ের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বি.ডি.এস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াকুব আলী বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির বিষয়ে গ্রামে দক্ষ শিক্ষকের খুবই অভাব। শিক্ষকরা দক্ষ না হওয়ায় শ্রেণিকক্ষে তারা শিক্ষার্থীদের ভালো ধারণা দিতে পারছেন না। ফলে মেধাবীরা শুধু ভালো ফল করছে। বাকি শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। সৃজনশীলের ওপর শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে এ সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৭ সালের জুনে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের সরকারি আদেশ জারি হয়। ২০০৮ সাল থেকে নবম শ্রেণিতে চালু হয়। ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম প্রবর্তন ঘটে। সে হিসেবে চলতি মাসে এ পদ্ধতির একযুগ পূর্তি হচ্ছে। কিন্তু এতদিনেও এ পদ্ধতি শিক্ষকরা পুরোপুরি আয়ত্তই করতে পারেননি। এ ব্যাপারে মাউশির ‘একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদন’ শীর্ষক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, সারাদেশের ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের দক্ষতা অর্জন করেছেন। তারা এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। বাকি ৪১ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। তাদের মধ্যে ১৩ দশমিক ১২ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। এ ধরনের শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরিই করতে পারেন না।

সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে সরকার ‘বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট’ (বেডু) নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে। এ সংস্থার পরিচালক অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষকের মান। সাধারণ শিক্ষক দূরের কথা, মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণেও আমরা এমন অনেক শিক্ষক পাচ্ছি, যারা ঠিকমতো সৃজনশীল বোঝেন না। এমনকি প্রশিক্ষণের ভাষাও বোঝেন না অনেকে। তিনি বলেন, সৃজনশীলে প্রশ্ন প্রণয়ন অত সহজ নয়। এর জন্য শিক্ষকের ওই বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা দরকার। বুঝতে হবে শিক্ষা মনস্তত্ত্ব।

সূত্র জানায়, শিক্ষকদের সৃজনশীলতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) নামের একটি প্রকল্প থেকে। এ ছাড়া মাউশির প্রশিক্ষণ শাখা থেকেই সৃজনশীলতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। তাদের মধ্যে কতজন সৃজনশীল প্রশিক্ষণ পেয়েছেন সে হিসাব কারও কাছেই নেই।

রাজধানীর মীরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা কম এবং নিয়োগে অনিয়ম থাকায় এতদিন মেধাবীরা এই পেশায় আসেননি। ফলে এখনও অনেক অদক্ষ শিক্ষক রয়েছেন।

সূত্র: দৈনিক সমকাল

পাঠকের মতামত: